ডেস্ক নিউজ : ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা করার আগে অনুমতি নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুর রহমান (প্রথম আলো, ১৭ মে ২০২২)।
ডিএমপির একজন অতিরিক্ত কমিশনার পদের কর্মকর্তার কাছ থেকে এই অনুমতি নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
এর আগে এই আইনে সাংবাদিকদের তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেপ্তার না করার কথা বলেছিলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
তিনি বলেছিলেন, সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হলে তাঁকে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেপ্তার করা যাবে না।
আরো পড়ুন – কালিহাতীতে নিলাম বালুর আড়ালে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে বিক্রি
তাঁকে সমন দিতে হবে। মামলা হওয়ার পর সাংবাদিক আদালতে জামিন চাওয়ার সুযোগ পাবেন (প্রথম আলো, ৩০ ডিসেম্বর ২০২১)।
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে এ ধরনের ‘ছাড়’ দেওয়ার খবরে একজন সাংবাদিক হিসেবে ‘আনন্দিত’ হওয়ারই কথা ছিল।
কিন্তু তেমনটা হতে পারছি না। এর কারণ, এই ছাড় যেমন বৈষম্যমূলক, তেমনি তা সংবিধানসম্মতও নয়।
বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী’।
এরপরও কোনো বিশেষ শ্রেণি-পেশার মানুষ বা পদাধিকারীকে ‘ছাড়’ বা ‘দায়মুক্তি’ দেওয়া যেতে পারে, যদি সেটি আইনে উল্লেখ থাকে।
কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কোথাও সাংবাদিকদের সম্পর্কে তেমন কিছু বলা হয়নি। তাহলে কোন এখতিয়ারে একজন মন্ত্রী বা পুলিশ কমিশনার সাংবাদিকদের এমন ছাড় দেওয়ার ‘হুকুম’ দেন?
আরো পড়ুন – কালিহাতীতে ছাত্রের বাবার হাতে প্রধান শিক্ষক লাঞ্ছিত, প্রতিবাদে বিক্ষোভ
আইন এবং আদালতের নির্দেশের এমন বৈষম্যমূলক বা পক্ষপাতমূলক প্রয়োগের বহু উদাহরণ আছে।
সম্প্রতি উচ্চ আদালতের রায়ে দুর্নীতির মামলায় দণ্ড বহাল থাকার পরও ঢাকা-৭ আসনের সাংসদ ও ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা হাজি মোহাম্মদ সেলিম বিদেশ সফর করেন।
সাবেক বিচারপতি এবং আইনজীবীদের অনেকে তাঁর এই বিদেশ সফরকে ‘বেআইনি’ বলে চিহ্নিত করেছেন।
এ ক্ষেত্রে কেউ কেউ সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। উচ্চ আদালতে সাজা বহাল থাকায় বহু অনুরোধ সত্ত্বেও সরকার তাঁকে বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি দেয়নি।
বাংলাদেশের সংবিধান বা আইনে যা-ই থাকুক না কেন, ব্যবহারিক ক্ষেত্রে কার ওপর কোনো আইন কীভাবে প্রয়োগ হবে, তা নির্ধারিত হয় সরকার, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, আমলাতন্ত্র ও আদালতের দ্বারা। এই প্রতিষ্ঠানগুলো নিরপেক্ষ ও জবাবদিহির সঙ্গে কাজ করবে কি না, সেটা আবার নির্ভর করে রাজনৈতিক সংস্কৃতির ওপর। এর ফলে আইন ও আইন প্রয়োগের সঙ্গে রাজনীতি বা ক্ষমতার সম্পর্কটা সরাসরি।
সেই সময় সরকারি দলের নেতা ও মন্ত্রীরা জোর গলায় বলেছেন, দণ্ডিত আসামির দেশের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।
কিন্তু হাজি সেলিমের ক্ষেত্রে সেই সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, হাজি সেলিমের বিদেশ যাওয়া-আসা আইন মেনেই হয়েছে।
কিন্তু খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে কেন সেই আইন প্রযোজ্য হলো না, সেই বিষয়ে তিনি কিছু বলেননি।
আরো পড়ুন – শিহাব হত্যা মামলা : আর কোন আসামি গ্রেপ্তার নাই
সরকার কর্তৃক মামলা প্রত্যাহার এবং রাষ্ট্রপতির ক্ষমার ক্ষেত্রেও আইনের ভিন্ন ভিন্ন প্রয়োগ দেখা গেছে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিবেচনায় যাঁদের মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে কিংবা যাঁরা রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ক্ষমা পেয়েছেন; স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা সরকার বা ক্ষমতাসীনদের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন।
সেটা নিয়ে তেমন কিছু বলার নেই। কোন প্রক্রিয়ায় কোন আইন মেনে ক্ষমা করা হচ্ছে, সেটাই হলো বিবেচ্য।
রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ক্ষমা পেতে হলে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণের ব্যাপারে হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে।
কিন্তু সেই শর্ত না মানার দৃষ্টান্তও আমাদের সমানে রয়েছে।
বিভিন্ন সময়ে নাশকতা, হামলা বা সংঘর্ষের ঘটনায় বিরোধী পক্ষের কেউ জড়িত থাকলে আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অতি দ্রুত ব্যবস্থা নিতে, তদন্ত করতে দেখি।
অপরদিকে সরকারি দলের কারও এ ধরনের ঘটনায় যুক্ততা থাকলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হয় নিষ্ক্রিয় থাকে কিংবা খুবই ঢিমেতালে কাজ করে।
কোনো কোনো ঘটনায় তদন্ত শুরু হওয়ার আগেই মন্ত্রী বা সরকারদলীয় নেতাদের বিভিন্ন মন্তব্য করতে দেখা যায়।
তাঁরা এসব ঘটনার জন্য একতরফাভাবে বিরোধী পক্ষগুলোকে দায়ী করেন।
আরো পড়ুন – হত্যাকারী আইনের আওতায় আসবে কি? শঙ্কায় নিহত শিহাবের পরিবার
তাঁদের এ ধরনের মন্তব্যের পর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পুলিশের তদন্তও সেই পথে এগোয়।
আর যদি কোনো ঘটনায় সরকারদলীয় নেতা-কর্মী বা সংগঠনের দৃশ্যমান সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়; অনেক ক্ষেত্রে তদন্ত হয় না বা হলেও মাঝপথে তা থেমে যায়।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে হাতুড়ি বাহিনীর হামলা কিংবা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে হেলমেট বাহিনীর হামলার ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ‘নীরবতা’—এ রকম বহু উদাহরণের একটি।
ওপরের উদাহরণগুলো থেকে এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে বাংলাদেশে কি আইন চলে ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছা অনুযায়ী?
মন্ত্রী, সরকারদলীয় নেতা, আমলা, পুলিশ—তাঁরাই নির্ধারণ করেন, কার ওপর কীভাবে আইন প্রয়োগ হবে?
তা না হলে সরকারি দলের লোকদের জন্য একরকম, আবার বিরোধীদলীয় লোকদের জন্য আরেক রকমভাবে কেন আইনের প্রয়োগ হবে?
কেন একই আইনে পুলিশের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের ‘ছাড়’ দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে; কিন্তু সাধারণ মানুষকে মামলা দিয়ে জেলে পাঠানো হচ্ছে?
আইনের এ রকম বৈষম্যমূলক ও পক্ষপাতমূলক প্রয়োগকে কি আইনের শাসন বলা যায়?
আরো পড়ুন – হত্যাকারী আইনের আওতায় আসবে কি? শঙ্কায় নিহত শিহাবের পরিবার
বাংলাদেশের সংবিধান বা আইনে যা-ই থাকুক না কেন, ব্যবহারিক ক্ষেত্রে কার ওপর কোনো আইন কীভাবে প্রয়োগ হবে, তা নির্ধারিত হয় সরকার, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, আমলাতন্ত্র ও আদালতের দ্বারা।
এই প্রতিষ্ঠানগুলো নিরপেক্ষ ও জবাবদিহির সঙ্গে কাজ করবে কি না, সেটা আবার নির্ভর করে রাজনৈতিক সংস্কৃতির ওপর; এর ফলে আইন ও আইন প্রয়োগের সঙ্গে রাজনীতি বা ক্ষমতার সম্পর্কটা সরাসরি।
বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য, আদালতের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আমলাতন্ত্রের নিরপেক্ষ অবস্থান ছাড়া ‘আইন সবার জন্য সমান’ হয় না।
বাংলাদেশে এখন এগুলোর কোনোটাই নেই আর এগুলো অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আইন চলবে ক্ষমতাসীনদের কথা বা নির্দেশেই।
তথ্য ও ছবি – প্রথম আলো, সম্পাদনা – অলক কুমার