বাসাইলের নথখোলার ভূক্তভোগীদের জিজ্ঞাসা – বালুখেকোদের এতো শক্তি কোথায়?

ঝিনাই নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন

অলক কুমার : অন্তত এক ডজন জাতীয় দৈনিক, স্থানীয় পত্রিকা ও অনলাইন পোর্টালে সংবাদ প্রকাশের পরও বন্ধ হয়নি বাসাইলের কাশিল ইউনিয়নের নথখোলা এলাকার ঝিনাই নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন।

এর ফলে গ্রামের শত শত একর জমি ও শতাধিক ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন হওয়ার পরেও নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে গড়ে তোলা হচ্ছে চায়না ‘ডেইরী ফিড’।

বাংলাদেশের ‘ফ্রেন্ডস এসোসিয়েট’ নামের একটি স্থানীয় কোম্পানীর যৌথ ব্যবস্থাপনায় এই কোম্পানিটি স্থাপন করা হচ্ছে।

টাঙ্গাইল-বাসাইল সড়কের কাশিল ইউনিয়নের প্রধান সড়কের পাশেই গড়ে তোলা হচ্ছে।

বিষয়টি নিয়ে স্থানীয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিলেও কর্তৃপক্ষ প্রভাবশালী হওয়ায় কোন সুরাহা হচ্ছে না।

ভূক্তভোগীদের প্রশ্ন – বালুখেকোদের এতো শক্তি কোথায়?

ভূক্তভোগীরা জানিয়েছেন, স্থানীয় সাংসদ ও প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই চলছে এই ধ্বংস যজ্ঞ। স্থানীয় প্রশাসন একাধিকবার অভিযান পরিচালনা করলেও বন্ধ হয়নি এই ধ্বংস যজ্ঞ।

ভূক্তভোগীদের অভিযোগ, এগুলো লোক দেখানো।

তারা জানান, প্রথম অভিযানে বালু সরবরাহের পাইপের ১৩টি নাট খুলে দিয়ে অভিযান সমাপ্ত করা হলেও পরদিনই আবার বালু উত্তোলন কাজ চালু করা হয়। এরপরের অভিযানেও একই চিত্র দেখা যায়।

ভূক্তভোগীরা জানান, স্থানীয় সাংসদ বালু খেকো মো. বাদল মিয়ার পেট্রোল পাম্পে নিয়মিত সময় দেন।

আর এজন্যই বাদল মিয়া তার বালু উত্তোলন কাজ নির্বিঘ্নে চালিয়ে যেতে পারতেছেন।

এছাড়াও বাদল মিয়ার রয়েছে বেতনভূক্ত একটি বিরাট সন্ত্রাসী বাহিনী। যার জন্য স্থানীয় নিরীহ ও ক্ষতিগ্রস্তরা কথা বলার সাহস পান না।

ঝিনাই নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন

বালু উত্তোলনের কাজ শুরু করার সময় স্থানীয় সহযোগী খোকা ভূক্তভোগীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করে হয়রানী করে।

সেই মামলায় নাবালক শিশুদের নামও রয়েছে বলে জানান তারা।

অপরদিকে, বালুখেকো বাদল মিয়া জানিয়েছেন, তারা বাল্কহেড দিয়ে যমুনা নদী থেকে মাটি আনেন।

কিন্তু শুস্ক মৌসুমে তিনি কিভাবে বাল্কহেড দিয়ে যমুনা নদী থেকে মাটি আনেন, সেই প্রশ্ন করেছেন স্থানীয় ভূক্তভোগীরা।

সেই বিষয়ে বাদল মিয়া জানান, নদীর আশে পাশের এলাকায় কয়েকশ শতাংশ জমি ক্রয় করেছেন, সেখান থেকে মাটি উত্তোলন করছেন তিনি।

কিন্তু ভূমির শ্রেণি পরিবর্তনের অনুমতির কোন কাগজ দেখাতে পারেন নি তিনি।

সরেজমিনে যা দেখা যায় :

চায়না ‘ডেইরী ফিড’ নামের এই প্রতিষ্ঠানের জন্য ৫২ বিঘা জমির মাটি ভরাটের কাজ করছে কাশিল গ্রামের মো. বাদল মিয়া।

ওই ৫২ বিঘা জমি নিচু হওয়ায় সেখানে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে পার্শ্ববর্তী নথখোলা এলাকার ঝিনাই নদী থেকে।

এতে ওই এলাকার শত শত একর ফসলি জমি, কাঠ বাগান ও শতাধিক ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে।

এছাড়াও নথখোলা ঝিনাই নদীর উপর নির্মিত সেতু ও সেতু সংলগ্ন নদীর পূর্ব পাশে মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত স্মৃতি স্তম্ভটি হুমকির মুখে পড়েছে।

সরেজিমিন গিয়ে আরো দেখা যায়, নথখোলা এলাকায় ঝিনাই নদীতে বালু উত্তোলনের জন্য বসানো হয়েছে ৫/৬টি ড্রেজার মেশিন; পাশেই রয়েছে দুইটি বাল্কহেড।

স্থানীয়রা জানান, দিনের বেলায় নদীর পশ্চিমপারে এবং রাতে নদীর মাঝখানে ড্রেজার বসিয়ে দিনরাত উত্তোলন করা হচ্ছে বালু।

আর এই বালু পাইপের মাধ্যমে প্রায় দুই কিলোমিটার দুরে চায়না কোম্পানীর জায়গা ভরাট করা হচ্ছে।

এতে করে পুরো নথখোলা এলাকা হুমকির মুখে পড়েছে।

আগামী বর্ষা মৌসুমে এই এলাকাটি একেবারে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে বলে এমনটাই আশঙ্কা করছেন এলাকাবাসী।

আব্দুল বারেক মিয়া নামের স্থানীয় বাসিন্দা জানান, রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই পক্ষ মুখোমুখি অবস্থান নিলেও এসব অবৈধ বালু ব্যবসার সময় তারা এক হয়ে কাজ করে।

এ কারনে তিনিসহ এলাকার লোকজন কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস পায় না।

তিনি জানান, টাঙ্গাইল জেলার কুখ্যাত বালু ব্যবসায়ী বাসাইলের মো. বাদল, স্থানীয় সকল জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন ও সরকার দলীয় লোকদের একত্রিত করেই এই অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে চলেছে দীর্ঘদিন ধরে।

মনির হোসেন নামের এক ব্যক্তি জানান, প্রতিবাদ করলে বিভিন্ন হুমকি দেয় বালু ব্যবসায়ীরা।

তারপরও তারা এলাকাবাসী তাদের গ্রামটি রক্ষায় মানববন্ধন, বিভিন্ন দপ্তরে স্মারকলিপি প্রদান করেছেন; তাতেও কোন লাভ হয়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কোম্পানীর কাজে নিয়োজিত একজন জানান, তারা সকল দপ্তর, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতাদের ম্যানেজ করেই বালু উত্তোলন করছেন।

এ নিয়ে কিছু করলে সাময়িকভাবে বন্ধ হলেও আবার ২/৩ দিন পর পুনরায় চালু হবে।

তদারকি প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনের বক্তব্য :

কোম্পানীর তদারকির দায়িত্বে থাকা মো. বাদল মিয়া জানান, বালু উত্তোলনের জন্য তিনি নদীর পশ্চিমপাড়ে জমি কিনেছেন।

সেখান থেকেই বালু উত্তোলন করে বাল্কহেড দিয়ে এপাড়ে এনে তা আনলোড করা হয়; অন্যের জমি বা নদী থেকে কোন বালু উত্তোলন করা হচ্ছে না।

আর যাদের জমি কিনেছেন তাদের প্রত্যেককে ওই কোম্পানীতে চাকুরীর দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে; এ কারনেই তারা জমিগুলো বিক্রি করেছেন।

টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আমিনুল ইসলাম জানান, চায়না কোম্পানী হচ্ছে শুনেছেন; তবে নদী থেকে বালু উত্তোলন করে ভরাট করা হচ্ছে কিনা এ বিষয়ে জানেন না।

এবিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে অবহিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।