করোনায় বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে পারে কৃষির সাব-সেক্টরগুলো

কৃষিবিদ ড. এম. মনির উদ্দিন

চীনের উহান থেকে করোনা ভাইরাস আজকে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের প্রতিটি দেশে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটাকে অনেক আগেই বৈশ্বিক মহামারী হিসাবে ঘোষনা দিয়েছে। আমাদের দেশেও ভাইরাসটি গত ৮ই মার্চ, ২০২০ প্রথম ধরা পড়ে এবং এটা ক্রমশই ছড়িয়ে পড়ছে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সর্বশেষ তার বক্তৃতায় যে দিক নির্দেশনা দিয়েছেন তাতে আমার বিশ্বাস, দেশের প্রতিটি মানুষ এতে আস্বস্থ হয়েছে এবং মহান আল্লাহতালা সহায় হলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যথাযথ দিক নির্দেশনায় আমরা সকলে মিলে অতীতে যেমন বিভিন্ন দুর্যোগকে মোকাবিলা করেছি সেভাবে করোনা ভাইরাসকেও জয় করতে পারবো ইনশাল্লাহ।

একথা অবশ্যই স্বীকার্য যে, বিশ্ব অর্থনীতি খুবই মন্দা অবস্থায় পড়েছে। বর্তমান বিশ্বে এক দেশের অর্থনীতি অন্য দেশের অর্থনীতির সাথে ঘনিণ্ঠভাবে সম্পর্কিত। বিশ্ব অর্থনীতির এই মন্দা অবস্থার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। প্রথমত, দেশের বড় আয়ের একটি উৎস ছিল প্রবাসীদের কষ্টার্জিত পাঠানো টাকা যা ইতিমধ্যে অনেকাংশেই কমে গেছে। আগামীতে বিশ্বে কাজের সুযোগ হযতো আরো সংকুচিত হয়ে আসবে। দ্ধিতীয়ত, দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আহরনের একটি বড় খাত ছিল আমাদের গার্মেন্টস সেক্টর। এই সেক্টরটিও বিশ্ব অর্থনীতির মন্দার শিকার হয়েছে। যে সমস্ত দেশ আমাদের গার্মেন্টস সেক্টরগুলোর তৈরী পোশাকের ক্রেতা ছিল তারাই আজকে বেশী বিপর্যয়ের মুখোমুখী। কাজেই কতদিন পর এগুলো ঠিক হবে তা বলা মুশকিল।

এমতাবস্থায়, আমাদের দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার একমাত্র শিল্প হচ্ছে কৃষি। বর্তমান কৃষি বান্ধব সরকারের গৃহীত বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়ার কারনে আজকে আমরা চাল, শাকসব্জি, ফলমুল, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পুর্ন। আমরা জানি, বর্তমানে সারা দেশের কৃষকের মাঠ ভরে আছে দেশের প্রধানতম ফসল বোরো ধানে। ফসলের বর্তমান অবস্থা ভাল এবং আল্লাহতালা সহায় থাকলে আর এক মাস পর উঠতে শুরু করবে বোরো ধান।

তবে, এই সময়টা আমাদের কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের খুবই সজাগ থাকা প্রয়োজন। কারন এই সময়ে কিছু পোকামাকড় বা রোগবালাই বিশেষ করে বাদামী গাছ ফড়িং, সিথ ব্লাইট, ব্যাকটেরিয়াল লিফ ব্লাইট যাতে আসন্ন বেরো ধানের কোন ক্ষতি করতে না পারে। আমাদের অবশ্যই মনে রাখা দরকার যে, বোরো ফসলটি যদি আমাদের পরিশ্রমী কৃষকেরা ভালভাবে ঘরে তুলতে পারে তাহলে তা দেশের আগামী এক বছরের খাবারের যোগান দিতে পারে। তাই কৃষি বিভাগের সার্বিক মনিটরিং অত্যন্ত জরুরী। সেইসাথে কৃষক যাতে বিভিন্ন বালাইনাশক প্রয়োজনমত হাতের কাছে পায় সেদিকেও নজর রাখা দরকার।

ইতিমধ্যে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কৃষকদের বেশী বেশী ফসল ফলানোর জন্য আহবান জানিয়েছেন। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতেও আমাদের কৃষক, লেয়ার খমারী, ব্রয়লার খামারী, গবাদিপশুর খামারী, মৎস খামারী সকলেই বাজারে প্রয়োজনীয় শাকসব্জি, ডিম, মাংস, মাছ সরবরাহ অব্যাহত রেখেছেন। অবশ্যই, এর জন্য উৎপাদকদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা জানানো দরকার। তবে, কষ্ট করে যারা এই কৃষিজ ভোগ্যপন্য উৎপাদন ও সরবরাহ করে যাচ্ছেন তাদের করুন আর্তনাদের চিত্রটি আমাদের অত্যন্ত ব্যথিত করে। করোনা পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে, লেয়ার খামারীরা প্রতিটি ডিম বিক্রয় করছে স্থানভেদে ৪-৬ টাকায়, ব্রয়লার মুরগী প্রতি কেজি বিক্রয় হচ্ছে ৪০-৬০ টাকায়, মাছ ও সব্জির দামেও একই অবস্থা। অথচ, খুচরা বাজারে সবকিছুর দাম বেশী। খুচরা বাজারে ডিম প্রতি ডজন ১০০-১২০ টাকা, ব্রয়লার মুরগী প্রতি কেজি ১২০-১৩০ টাকা, মাছ ও শাকসব্জির দামও চড়া। বিষয়টা এ রকম যে, উৎপাদক লোকসান দিয়ে পন্য বিক্রয় করছে আবার ভোক্তাও বেশী দাম দিয়ে পন্য কিনছে। এই যে, মাঝখানে টাকাটা লুফে নিচ্ছে যারা তাদেরকে সনাক্ত করে উপযুক্ত শাস্তি দেয়া দরকার। মানুষের এই ক্রান্তিকালে যারা আমাদের পরিশ্রমী কৃষক/খামারীদের ঠকাচ্ছে তারা শুধু অপরাধই না বরং মানবতার শক্র।

আবারো উল্লেখ করতে চাই যে, বর্তমান কৃষি বান্ধব সরকারের নিরলস প্রচেষ্টায় আমরা কষিজ উৎপাদনে এগিয়েছি। এটাকে আগামীতেও অব্যাহত রাখা জরুরী। কারন কৃষিই বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের উন্নয়নের হাতিয়ার। তাই, যদি একবার আমাদের খামারীরা পড়ে যায় তাহলে আর দাঁড়াতে পারবে না। ব্যাহত হবে আমাদের আগামী দিনের উন্নয়নের পথচলা। তাই, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় এবং অধিদফতরগুলোকে অনুরোধ করবো দেশের এই নাজুক অবস্থায় আমাদের অসহায় কৃষক ও খামারীদের দিকে দৃষ্টি দেয়ার। আশা করি, আমরা সকলে যার যার অবস্থান থেকে সম্মিলিতভাবে করোনা ভাইরাসকে জয় করে আমাদের দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখবো।